আপনি চীনের কৃত্রিম সূর্য প্রকল্প সম্পর্কে কিছু জানেন কি?

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত মানুষ বুঝতে পারে নি সূর্যের অফুরন্ত শক্তির উৎস কী। আইনস্টাইন আমাদের দিয়ে গেলেন তাঁর মহাতত্ত্ব ‘আপেক্ষিকতাবাদ’। তা থেকেই জানা গেল শক্তির নতুন একটি উৎসের কথাঃ ভর। যদি কোনভাবে বস্তুর কিছুটা ভর শক্তিতে পরিণত করা যায় তবে তার পরিমাণ হবে বিপুল।

এরপর আবিষ্কার হল নিউক্লীয় বিভাজন (Nuclear fission) বিক্রিয়া যাতে একটি বড় আকৃতির পারমাণবিক নিউক্লিয়াস (যেমন ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম) একটি নিউট্রনের ধাক্কায় বিভাজিত হয়ে যায় ও বিক্রিয়ায় সামগ্রিকভাবে কিছুটা ভর হারিয়ে যায় যা আইনস্টাইনের সূত্র মেনে জন্ম দেয় বিপুল পরিমাণ শক্তির। একে ব্যবহার করেই তৈরি হল একদিকে বিধ্বংসী পরমাণু বোমা (অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন বিক্রিয়া), অন্যদিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ (নিয়ন্ত্রিত বিভাজন বিক্রিয়া)।

তখনও সূর্যের শক্তির রহস্য মানুষের অজানা। অল্পকাল পরেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন এই অফুরন্ত শক্তির পেছনেও আইনস্টাইনের সেই আশ্চর্য ফর্মুলা। তবে এ হল আরেকপ্রকারের বিক্রিয়া যার নাম নিউক্লীয় সংযোজন (Nuclear fusion)। এতে একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস (যেমন- হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম) যুক্ত হয়ে নতুন একটি নিউক্লিয়াস তৈরি হয়, সামগ্রিকভাবে কিছুটা ভর হারায় এবং জন্ম হয় বিপুল পরিমাণ শক্তির।

বিভাজনকে ব্যবহার করে যেমন তৈরি হয়েছিল পরমাণু বোমা তেমনি সংযোজনকে ব্যবহার করে তৈরি হল মহাশক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা (অনিয়ন্ত্রিত সংযোজন বিক্রিয়া)। কিন্তু মানবকল্যাণের জন্য বিদ্যুৎ? না, সেটা অত দ্রুত করা গেল না মোটেই।

অনেক দশক থেকেই মানুষ চেষ্টা করে চলেছে সূর্যের শক্তিকে করায়ত্ত করার। তার জন্য আয়ত্ত করতে হবে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া। তাহলেই মানবসভ্যতার হাতে এসে যাবে পরিবেশবান্ধব শক্তির অফুরন্ত ভাণ্ডার কারণ এই বিক্রিয়া হয় হাইড্রোজেনের সাহায্যে আর হাইড্রোজেন পাওয়া যায় জল থেকে। পৃথিবীতে জলের কোনও অভাব নেই। বিভাজন বিক্রিয়া থেকে সংযোজনে প্রায় ৪ গুণ এবং কয়লা, তেল ইত্যাদির সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার থেকে সংযোজনে প্রায় ৪০ লক্ষ গুণ বেশী শক্তি পাওয়া যায়। আর সংযোজন বিক্রিয়া সম্পূর্ণ দূষণবিহীন। কিন্তু সমস্যা হল একে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন।

এর কারণ হল, আগেই বলেছি এই বিক্রিয়ায় একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস (যেমন- হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম) যুক্ত হয়ে নতুন একটি নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। এর জন্য ওই হালকা নিউক্লিয়াসগুলিকে অত্যন্ত দ্রুত ছুটে এসে সংঘর্ষ ঘটাতে হয় (কারণ মনে রাখতে হবে, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে রয়েছে পজিটিভ চার্জের প্রোটন এবং তারা কাছাকাছি এলে অত্যন্ত শক্তিশালী বিকর্ষণ কাজ করে যাকে ছাপিয়ে সংঘর্ষ ঘটাতে হয়)। এই গতি পেতে হলে শুরুতেই চাই প্রচণ্ড তাপ। হাইড্রোজেন বোমার ক্ষেত্রে এই তাপ সৃষ্টি করা হয় একটি বিভাজনভিত্তিক পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত সংযোজন পেতে আগে পরমাণু বোমা ফাটানো সম্ভব নয়- তাতে নিউক্লীয় চুল্লীসহ সেই অঞ্চলটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!

এই কারণে সংযোজন ঘটাতে প্রথমে সৃষ্টি করা হয় প্লাজমা যা সেই প্রচণ্ড উত্তাপ সরবরাহ করতে পারে নিয়ন্ত্রিতভাবে ও একটি ক্ষুদ্র সংহত অঞ্চলে। প্লাজমা হল একটি গ্যাসের সেই অবস্থা যখন তার পরমাণুগুলি ইলেকট্রন হারিয়ে তড়িতাহিত হয়ে পড়েছে। নানা উপায়ে পরীক্ষাগারে প্লাজমা সৃষ্টি করা যায়, যেমন- অত্যন্ত গরম করে, শক্তিশালী তড়িৎক্ষেত্র প্রয়োগ করে বা বাইরে থেকে পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন পাঠিয়ে ধাক্কা দিয়ে ইত্যাদি।

এরপর এই প্লাজমাকে ধরে রাখার ও একটি নির্দিষ্ট আকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এই নির্দিষ্ট আকৃতির প্রচণ্ড গরম প্লাজমাময় অঞ্চলে সংযোজন বিক্রিয়া অবশেষে ঘটতে পারার মত প্রয়োজনীয় শক্তি থাকে। প্লাজমা ধরে রাখা ও নির্দিষ্ট আকৃতি দেওয়ার এই পদ্ধতিকে বলে ‘Plasma confinement’।

যে যন্ত্রে এই কাজটি করা হয় তাকে বলে ‘Tokamak’- রাশিয়ান ভাষায় যার অর্থ ‘toroidal’naya kamera s magnitnymi katushkami)’ — toroidal chamber with magnetic coils। এই যন্ত্রে ম্যাগনেটিক কয়েলের সাহায্যে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করে তার সাহায্যে প্লাজমাকে একটি torus আকৃতিতে আবদ্ধ করা হয়।

তবে এই Plasma confinement এর কাজটিও অত্যন্ত কঠিন ও জটিল। মূল সমস্যা হল এই torus আকৃতির প্লাজমাকে tokamak এও সামান্য সময়ই ধরে রাখা যায়। এর স্থায়িত্ব ও উষ্ণতা বৃদ্ধি বিজ্ঞানীদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ। এখন বিশ্বের বেশ কিছু দেশ এই বিষয়ের ওপর গবেষণা চালাচ্ছে ও ক্রমশ উন্নত tokamak তৈরির মাধ্যমে প্লাজমার স্থায়িত্ব ও উষ্ণতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

সবচেয়ে আধুনিক tokamak গুলিকে বলে Superconducting tokamak।

বর্তমানে ৪ টি দেশের কাছে এইরকম Superconducting tokamak রয়েছেঃ ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভারত।

Tore Supra বা WEST tokamak, ফ্রান্স

KSTAR tokamak, দক্ষিণ কোরিয়া

EAST tokamak, চীন

SST-1 tokamak, ভারত

এছাড়া আরও কিছু নতুন Superconducting tokamak তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে:

জাপানের JT-60 SA

ও চীনের HL-2M tokamak।

এই tokamak গুলি একেকটি একেকভাবে বিশ্বে অনন্য। আরও অন্যান্য কিছু দেশেরও নিজস্ব tokamak রয়েছে (যেমন- আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপের কিছু দেশ ইত্যাদি)। plasma confinement ও সংযোজন বিক্রিয়া পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করছে এরা। এই যন্ত্রগুলিকে পৃথিবীর বুকে একেকটি ক্ষুদ্র সূর্য বলা যেতে পারে!

চীনের HL-2M tokamak অতি সম্প্রতি একটি অসাধারণ নজির গড়েছে। এটি ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস প্লাজমা উষ্ণতায় পৌঁছাতে পেরেছে। ভবিষ্যতে এটি ২০ কোটি ডিগ্রীতে পৌঁছাতে পারবে বলেও আশা করা হচ্ছে। তুলনার জন্য বলি, সূর্যের কেন্দ্রে তাপমাত্রা থাকে ১.৫ কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস (যদিও সূর্যে তার স্থায়িত্ব হয় কয়েকশো কোটি বছর যেখানে tokamak এ তার স্থায়িত্ব কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট)। চীনের প্রাপ্ত উষ্ণতা tokamak গবেষণায় একটি মাইলস্টোন। একেই চীনের ‘কৃত্রিম সূর্য’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ২০২০ সালে যন্ত্রটি পুরোপুরি চালু হয়ে যাবে।

[উল্লেখ্য, এখনও কোনও দেশই কিন্তু সংযোজন বিক্রিয়াকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। এটা হতে হতে আরও ২০-৩০ বছর লাগবে। এখন প্লাজমার স্থায়িত্ব ও উষ্ণতা বৃদ্ধি, যন্ত্রে প্রদত্ত শক্তির তুলনায় প্রাপ্ত তাপশক্তি উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ানো, ওই প্রচণ্ড তাপে যন্ত্রের নিজের সহ্যক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি চেষ্টা চলছে। এগুলো সম্পূর্ণ না হলে ব্যাবসায়িক সংযোজন চুল্লী তৈরি সম্ভব নয়]

চীনের কৃতিত্ব দ্বারা মানবজাতির কী উপকার হতে পারে?

এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরিষ্কার কেন চীনের এই কাজ এত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ন্ত্রিত সংযোজন বিক্রিয়া করায়ত্ত্ব হলে মানবসভ্যতার আগামী কয়েক হাজার এমনকি কয়েক লক্ষ বছরের পরিবেশবান্ধব শক্তির জোগান মানুষের হাতে চলে আসবে।

বর্তমানে সংযোজন পদার্থবিদ্যা গবেষণায় অগ্রগণ্য দেশগুলি হাত মিলিয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে একটি বৃহৎ সংযোজন চুল্লী তৈরির করার জন্য। এটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম tokamak। এই মেগাপ্রজেক্টে যোগ দিয়েছে ৩৪ টি দেশ (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত)। প্রজেক্টটির নাম ‘International Thermonuclear Experimental Reactor’ (ITER)। এটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল বিজ্ঞান প্রজেক্ট (প্রথম- আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন)। প্রজেক্টের শর্তানুযায়ী এতে ইউরোপ ৫/১১ ভাগ অবদান রাখবে এবং বাকী ৬ দেশ প্রত্যেকে ১/১১ ভাগ করে অবদান রাখবে। সদস্যরা নিজের দেশে গবেষণা করে যেসব জ্ঞান লাভ করবে সেগুলি এনে এই প্রজেক্টে প্রদান করবে এবং এইভাবে সকলের মিলিত চেষ্টায় ও অবদানে যে চুল্লী তৈরি হবে তার প্রযুক্তি সব সদস্য সম্পূর্ণভাবে পাবে। আর একবার এই প্রজেক্ট সাফল্য পেলে তৈরি হবে বিশ্বের প্রথম সংযোজন শক্তিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। তারপর বিশ্বের অন্যান্য দেশও বানিজ্যিকভাবে এই সদস্য দেশগুলি থেকে সংযোজন শক্তিকেন্দ্র পেতে পারবে। মানবসভ্যতা এগিয়ে যাবে বড় এক ধাপ।

২০২৫ সালে এই যন্ত্র প্রথম চালু হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে যাতে প্লাজমা উৎপাদন শুরু হবে এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ সংযোজন বিক্রিয়া চালু হবে। তবে বানিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আরও অনেকটা সময় লাগবে (এই শতকের মাঝামাঝির দিকে সেটা হওয়া সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে)।

চীন এই প্রজেক্টের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাই চীন নিজের দেশে সংযোজন গবেষণায় যে অগ্রগতি করছে তা পরোক্ষে সম্পূর্ণ সভ্যতার অগ্রগতির সহায়ক হতে চলেছে কারণ তাঁদের আবিষ্কৃত পদ্ধতি ITER এর অংশ হবে।

ফ্রান্সে নির্মীয়মাণ ITER

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *