বিজ্ঞানীরা কীভাবে জানেন যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে?

দেখা যাক, এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি, এর সম্প্রসারণ আর ধ্বংসের বিষয়ে কোরআন ও বেদে কী লেখা আছে। বিজ্ঞান কি তা প্রমান করতে পারছে? করলেও বা কতটুকু পেরেছে?

দেড় হাজার বছর আগের আল কোর’আনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“আমিই এ মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছি প্রচণ্ড শক্তি দ্বারা আর আমিই তা সম্প্রসারিত করছি।” (সূরা আয-জারিয়াত ৫১:৪৭)

আর প্রাচীন বেদে নাসাদিয় সুক্ত ও হিরন্যগর্ভ সুক্তর কথা যা দ্বারা
মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।

“আপ হ য়দ বৃহাতিরিবিশ্বমায়ান গর্ভম…”
“সেই হিরন্যগের্ভ ছিল উত্তপ্ত তরল যাতে ছিল সৃষ্টির সমস্ত বীজ”
(ঋগবেদ ১০.১২১.৭)

“তারপর যেখানে বিস্ফোরন ঘটল গলিত পদার্থ থেকে, বিন্দু থেকে যেন সব প্রসারিত হতে শুরু হল”
(ঋগবেদ ১০.৭২.২)

বিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক যুগে রুশ পদার্থবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান ও বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জেস লেমেট্রে তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করে জানান যে মহাকাশ সম্প্রসারিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিস্ফোরণের (বিগ ব্যাং) মাধ্যমে সৃষ্টির পর থেকেই প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে মহাবিশ্ব। নানা গবেষণায় সম্প্রসারণের গতিবেগ সম্পর্কেও ধারণা দেন তারা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে, বিজ্ঞানীদের অনুমানের চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ বেশি দ্রুতগতিতে প্রসারিত হচ্ছে মহাবিশ্ব। বিগ ব্যাং নিয়ে কোরআন আর বেদে ছিলো –

”অবিশ্বাসীরা কি চিন্তা করে দেখে না যে,একসময় নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল,অতঃপর আমি তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিলাম এবং জীবন্ত সবকিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম? তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না?” (সূরা আল-আম্বিয়া ২১:৩০)

“তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনয়নকারী; তিনি যখন কিছু করতে চান তখন সেটিকে বলেন: ’হও’, অমনি তা হয়ে যায়।” (সূরা আল-ইমরান ৩:১১৭)

এই আয়াতদ্বয় দ্বারা মহাবিশ্ব সৃষ্টির সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। Big Bang Theory অনুযায়ী একসময় মহাবিশ্বের সকল বস্তু আড়ষ্ট অবস্থায় ছিল, একটি বিন্দুতে। অতঃপর বিস্ফোরণের মাধ্যমে তা আলাদা হয়ে গেছে। তাছাড়া সমস্ত জীবদেহের ৮০-৮৫%-ই পানি দিয়ে গঠিত।

বেদেও একই কথা বর্ণিত আছে-
“তম অসিৎ তমস… তপসস্তন্মহিনাজা
য়াতৈকম”
“চারদিক ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন।সমস্ত জিনিস একত্রে পুন্জীভুত ছিল।সেখান থেকে প্রচন্ড তাপের সৃষ্টি হল”।(ঋগবেদ ১০.১২৯.৩)

“সেই বিস্ফোরিত অংশসমূহ থেকে বিভিন্ন গ্রহ,নক্ষত্র তৈরী হল”। (ঋগবেদ ১০.৭২.৩)

বেদান্ত সূত্র(4/22) “অনাবৃতিঃ শব্দহম” অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমেই সৃষ্টির শুরু।

নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দাবি, হাবল স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে তারা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের এই গতিবেগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারস’ এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী অ্যাডাম রেইসের নেতৃত্বে গবেষক দল পৃথিবীর কাছের ছায়াপথের ৭০টি নক্ষত্রের ওপর গবেষণা চালায়। তারা নক্ষত্রগুলোর বিচ্ছুরিত আলো, উজ্জ্বলতা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন।

টেলিস্কোপ হাবল কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান একেকটি নক্ষত্রকে ৯০ মিনিট করে পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন সময়ের ছবি তুলে রাখে। গবেষণায় পাওয়া তথ্যকে প্রায় নির্ভুল বলে উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক রেইস। পাশাপাশি মহাকাশ নিয়ে গবেষণায় আরও নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বনের প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি। তার মতে, অত্যাধুনিক তত্ত্ব ও যন্ত্রের ব্যবহারে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও বেশি জানা সম্ভব হবে।

মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে, তবে ঠিক ফুটবলের মতো সব দিকে সমান ভাবে ফুলে ফেঁপে উঠছে না। কোনও বিশেষ একটি দিকেই বেশি ফুলে ফেঁপে উঠছে মহাবিশ্ব। অনেক বেশি দ্রুত গতিতে। ফলে, তার চেহারাটা হয়ে যাচ্ছে অনেকটা রাগবি বলের মতো। যার পেটটা ফোলা।

মহাবিশ্বের সেই উত্তরোত্তর বাড়-বৃদ্ধির গতিটা কোনও বিশেষ একটা দিকে বেশি। অন্য দিকে সেটা কম। যেন এই মহাবিশ্বকে কেউ বা কিছু একটা বিশেষ অভিমুখেই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে!

মহাকাশবিজ্ঞানের চালু সবক’টি মডেলের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে এ কথা জানালেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালি অধ্যাপক। সুবীর সরকার। তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণায়। যে পর্যবেক্ষণের জন্য ন’বছর আগে পদার্থবিজ্ঞানে তিন জনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, সুবীর ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণা তাকেই সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাল।

গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এ। যে গবেষকদলে রয়েছেন আরও এক ভারতীয়। কোপেনহাগেনের নিল্‌স বোর ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মহম্মদ রামিজ। রয়েছেন প্যারিসের ‘ইনস্টিটিউট দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক’-এর দুই অধ্যাপক জ্যাকস কলিন ও রয়া মোহায়ায়ি।

তাঁর গবেষণাই প্রথম জানাল, উত্তরোত্তর আরও আরও বেশি গতিতে (যাকে বলা হয় ত্বরণ বা ‘অ্যাকসিলারেশন’) ফুলে ফেঁপে ওঠার ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ একটি অভিমুখের দিকেই মহাবিশ্বের যাবতীয় পক্ষপাত। বা, কোনও অজানা কারণে সেই দিকেই মহাবিশ্বের প্রণিপাত!

স্টেশন ছাড়ার পর ট্রেন যে ভাবে ধাপে ধাপে তার গতিবেগ বাড়ায়, তাকেই বলে ত্বরণ। গত ২০/২২ বছর ধরে আমাদের ধারণা, মহাবিশ্ব উত্তরোত্তর আরও আরও বেশি গতিতে (বা ত্বরণ) ফুলে ফেঁপে উঠছে। সব দিকে, সমান ভাবে। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই এই ধারণার জন্ম। এই পর্যবেক্ষণের জন্যই ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান সল পার্লমাটার, ব্রায়ান স্মিড্‌ট ও অ্যাডাম রিস।

চ্যালেঞ্জার্স! রয়া মোহায়ায়ি (বাঁ দিক থেকে), সুবীর সরকার, জ্যাকস কলিন ও মহম্মদ রামিজ।

মহাকাশবিজ্ঞানীদের (‘কসমোলজিস্ট’) ধারণা, ১৪০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পর থেকেই নয়। এই ত্বরণ শুরু হয়েছিল মহাবিশ্বের জন্মের মোটামুটি ৭০০ কোটি বছর পরেই।

মহাবিশ্বকে ফুলে ফেঁপে ওঠার শক্তি জোগাচ্ছে কে?

কিন্তু মহাবিশ্বকে যে নিবিড় ‘মায়া’র বন্ধনে বেঁধে রেখেছে অভিকর্ষ বল। ঢিল আকাশে ছুড়লে তার গতিবেগ কমতে কমতে উপরে উঠে একটা সময় শূন্য হয়ে যায়। আর তখনই অভিকর্ষ বলের টানে ঢিলটি ফিরে আসে মাটিতে।

একই নিয়মে বিগ ব্যাংয়ের পর মহাবিশ্ব ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করলেও তার হার ক্রমশ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে মহাবিশ্ব উত্তরোত্তর আরও আরও বেশি গতিতে সব দিকে সমান ভাবে ফুলে ফেঁপে উঠছে কেন?

এই বাড়তি গতিতে ফুলে ফেঁপে ওঠার শক্তিটা কে জোগাচ্ছে মহাবিশ্বকে?

এর ব্যাখ্যা দিতেই আসে অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জির প্রসঙ্গ। যা মহাবিশ্বের মোট ভরের ৬৮ শতাংশ। বাকি ২৭ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য পদার্থ আর ৫ শতাংশ আমাদের চেনা-জানা পদার্থ।

মহাকাশবিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, এই অদৃশ্য শক্তিই মহাবিশ্বকে সব দিকে সমান ভাবে উত্তরোত্তর বেশি গতিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে। একটা বেলুন ফোলানো হলে যেমন তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা দু’টি পিঁপড়ের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে যায়, তারা নড়াচড়া না করলেও, ঠিক তেমনই মহাবিশ্ব উত্তরোত্তর ফুলে ফেঁপে ওঠার ফলে গ্যালাক্সির ঝাঁকগুলিও একে অন্যের চেয়ে দূরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। কোনও অদৃশ্য শক্তি না থাকলে, যেটা কিছুতেই সম্ভব হত না। সেই শক্তিই মহাবিশ্বের অভিকর্ষ বলকে অগ্রাহ্য করে তাকে সব দিকে সমান ভাবে উত্তরোত্তর আরও বেশি গতিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে।

‘সাম্যবাদী’ নয় মহাবিশ্বও! ‘ভোগে’ একদেশদর্শিতায়?

সুবীরের গবেষণার অভিনবত্ব, তিনি এই অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন। এই প্রথম। জানালেন, খুব সম্ভবত অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি বলে কিছুই নেই মহাবিশ্বে। ফলে, ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বকে সব দিকে সমান ভাবে উত্তরোত্তর বেশি গতিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে, এই ধারণাটা ঠিক নয়।

সুবীররাই প্রথম দেখালেন, আমাদের মহাবিশ্বও অসাম্যে বিশ্বাস করে। পছন্দ তার বৈষম্যই। কোনও বিশেষ একটি দিকের প্রতিই তার পক্ষপাতিত্ব। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মহাবিশ্ব কোনও বিশেষ একটি অভিমুখেই উত্তরোত্তর বেশি গতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সব অভিমুখেই মহাবিশ্ব এই একই গতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠছে না। পিছন থেকে অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি কলকাঠি নাড়লে যেটা হত।

সুবীর অবশ্য এও বলেছেন, ‘‘আমাদের এই দাবি অভ্রান্ত প্রমাণের জন্য আরও পর্যবেক্ষণ আর তার থেকে আরও অনেক তথ্য পাওয়ার প্রয়োজন।’’

তবে এই গবেষণাই প্রথম ইঙ্গিত দিল, গোটা মহাবিশ্বেই রয়েছে অসাম্য। প্রায় ১৪০০ কোটি বছরের মহাবিশ্ব মোটেই ‘সাম্যবাদী’ নয়! তার পছন্দ বরং অসাম্যই। তাই প্রত্যেকটি অভিমুখে এই মহাবিশ্বের উত্তরোত্তর বেশি গতিতে ফুলে ওঠার হারটা সমান নয়। বিশেষ একটি অভিমুখে সেটা বেশি। সেই অভিমুখেই মহাবিশ্বের যাবতীয় পক্ষপাত! অন্যান্য অভিমুখে সেটা অনেক কম। হয়তো বা নেইও।

এই গবেষণার কৃতিত্ব, তা মহাকাশবিজ্ঞানের চালু মডেলকে একটি মস্ত বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে। কারণ, সেই মডেল এত দিন ধরে যে বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই গভীর বিশ্বাসের মর্মমূলেই সরাসরি আঘাত হেনেছেন সুবীর ও তাঁর সহযোগীরা।

চালু মডেলগুলির বিশ্বাসের ভিত্তিটা আদতে কী?

প্রথম বিশ্বাসটা হল, গোটা মহাবিশ্বই‘হোমোজিনিয়াস’। সমসত্ব। বালতির দুধে জল মেশালে যেমন হয়। বালতির যেখান থেকেই দুধ তুলবেন, সেখানেই দুধ আর জলের মিশেল দেখবেন একই রকম। তেমনই একই রকম মহাবিশ্বের সর্বত্র। একই ভাবে গড়ে উঠেছে। এলাকাভেদে তার যাবতীয় ‘সম্পদে’র ভাগ-বাঁটোয়ারায় কোনও বৈষম্য নেই। কেউ বলতে পারবেন না মহাবিশ্ব ‘একচক্ষু’!

তেমনই একই মানের ত্বরণে সব অভিমুখে এই মহাবিশ্বকে ফুলিয়ে- ফাঁপিয়ে তুলছে যে, সেই অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জিও সর্বত্রই সমান। সেটা কোথাও একটু কম বা কোথাও একটু বেশি নয়। তার চরিত্র বা আচার, আচরণেও কোনও ফারাক নেই।

দ্বিতীয় বিশ্বাসটা হল, আমাদের এই পরিচিত মহাবিশ্বের পক্ষপাতও নেই কোনও দিকে। না ডান, না বাম। এমনকী, তার একটু বেশি পছন্দ ঈশান বা অন্য কোনও কোণ, তা-ও বলা যাবে না। যাকে ‘কসমোলজি’ বা মহাকাশবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘আইসোট্রপিক’।

কোনও একটি বস্তুকে উত্তর-দক্ষিণে কোণাকুণি ভাবে রাখলে তার যা ধর্ম হয়, তাকে পূর্ব-পশ্চিমে কোণাকুণি ভাবে রাখলেও যদি সেই একই ধর্ম দেখা যায়, তা হলে সেটাকেই বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘আইসোট্রপিক’।

যেহেতু ডার্ক এনার্জিই সব দিকে মহাবিশ্বকে সমান ভাবে উত্তরোত্তর আরও আরও বেশি গতিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চলেছে বলে ধরে নেওয়া হয় মহাকাশবিজ্ঞানের সবক’টি চালু মডেলেই, তাই এই অদৃশ্য শক্তিকেও ধরে নেওয়া হয় মহাবিশ্বের মতোই হোমোজিনিয়াস ও আইসোট্রপিক। সমসত্ব ও দিক-নিরপেক্ষ।

ফুলে-ফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয়েছে গ্যালাক্সি, গ্যালাক্সির ঝাঁক ও মহাঝাঁক, কোটি কোটি তারা ও নক্ষত্রমণ্ডল।

ডার্ক এনার্জি বলে কিছু নেই তা হলে…?

এই গবেষকরাই প্রথম মহাকাশবিজ্ঞানের সবক’টি চালু মডেলের বিশ্বাসের এই ভিতদু’টিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস দেখালেন। পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া অভিনব তথ্যাদিকে বিশ্লেষণ করে।

সুবীরের বক্তব্য, ডার্ক এনার্জিকে যেহেতু সমসত্ব ও দিক-নিরপেক্ষ বলে ধরা হয়, তাই মহাবিশ্বের একটি বিশাল অংশের কোনও একটি বিশেষ অভিমুখে এই ভাবে উত্তরোত্তর বেশি গতিতে ফুলে, ফেঁপে ওঠার পিছনে অন্তত ডার্ক এনার্জির কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না।

কীসের ভিত্তিতে এটা বলছেন সুবীর?

তাঁরা মোট ৭৪০টি সুপারনোভা দেখেছেন। সুপারনোভা হল কোনও নক্ষত্রের মৃত্যুদৃশ্য। যখন ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কোনও নক্ষত্র ফেটে যায়। তার ফলে, যে আলোটা বেরিয়ে আসে, সেটাই বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা।

সুপারনোভা হলে এই মহাবিশ্বে তা দেখতে লাগে আলোর একটা বাল্বের মতো। সুবীরের দেখা সুপারনোভাগুলির আলো যেন কোনও বিশেষ একটি দিকেই উত্তরোত্তর বেশি গতিতে দূরে চলে যাচ্ছে। খুব অল্প ব্যাসের একটা এলাকায় এই পর্যবেক্ষণ হলে বলা যেত, এটা আপেক্ষিক ঘটনা। কিন্তু সুবীর আকাশের বিশাল একটা এলাকার উপর করা পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে এটা ঘটতে দেখেছেন।

বিগ ব্যাংয়ের পর বেরিয়ে আসা বিকিরণ ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। সেটাই মহাবিশ্বের ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি)’। হঠাৎ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে টেলিভিশনের স্ক্রিনে যে ঝিরঝিরে ছবিটা ভেসে আসে।

সুবীর বলছেন, ‘‘এই সিএমবি-রও একদেশদর্শিতা রয়েছে! সিএমবি-ও দিক-নিরপেক্ষ নয়।’’ এটাই গবেষকদের কথায়, ‘ডাইপোল অ্যানাইসোট্রপি’।

গবেষকদের দাবি অভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ার জন্য আরও অনেক তথ্যের প্রয়োজন, এটা স্বীকার করে নিয়েছেন সুবীর। তবে এও বলেছেন, ‘‘এই তথ্যের অপ্রতুলতা ছিল নোবেলজয়ীদের ক্ষেত্রেও। তাঁরা খুব বেশি হলে ৯০টি সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আর সেটাও করেছিলেন আকাশের একটি দিকেই। ঘটনাচক্রে, সেই অভিমুখেই মহাবিশ্বের ত্বরণটা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। নোবেলজয়ীদের হাতে যদি আরও তথ্য থাকত, তাঁরা যদি গোটা আকাশ পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেতেন, তা হলে সম্ভবত ওঁরা বুঝতে পারতেন আকাশের সর্বত্র ত্বরণটা সমান ভাবে হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে হয়তো তাঁরা এই ত্বরণের দায়টা ডার্ক এনার্জির কাঁধেও চাপিয়ে দিতেন না।’’

নোবেলজয়ী গবেষণা নিয়ে তো প্রশ্নটা উঠল অন্তত: অমিতাভ রায়চৌধুরী

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ‘পালিত অধ্যাপক’ কণাপদার্থবিজ্ঞানী অমিতাভ রায়চৌধুরীরও একই বক্তব্য। তাঁর কথায়, ‘‘মহাবিশ্ব আর অদৃশ্য শক্তি, দু’টিই সমসত্ত্ব এবং দিক-নিরপেক্ষ, গত আড়াই দশক ধরে এই ধারণাটাই বিজ্ঞানী মহলে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই নোবেলজয়ীরা এই ধারণায় পৌঁছেছিলেন বলে কেউ আর অন্য ভাবে‌ ভাবা যায় বলে দাবি করেননি। সুবীরদের কৃতিত্ব, তিনি সেটা করতে পেরেছেন। এমনকী, এই প্রশ্নটাও তুলে দিতে পেরেছেন, সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য কি পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ আর তার থেকে পাওয়া তথ্যাদি যথেষ্ট ছিল নোবেলজয়ীদের হাতে?’’

অমিতাভের বক্তব্য, জেনিভায় ‘সার্ন’-এ হিগস বোসন কণা আবিষ্কারের ঘটনার কথা এই সূত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই সময় ‘সার্ন’-এর দু’টি গবেষণাগার ‘সিএমএস’ এবং ‘অ্যাটলাস’-এর দুই গবেষকদল একেবারে স্বাধীন ভাবে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় না করেও। এ ক্ষেত্রেও তেমন একটি ঘটনা ঘটতে হবে। একেবারে নিরপেক্ষ ভাবে আরও বেশি পর্যবেক্ষণ ও সেখান থেকে পাওয়া আরও বেশি তথ্যাদি নিয়ে অন্য একদল বিজ্ঞানীর এ বার সুবীরদের বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত হতে হবে। তা হলেই আক্ষরিক অর্থে, জমি পেয়ে যাবে সুবীর ও তাঁর সহযোগীদের বক্তব্য।‘ডিফেন্ডার্স’। সোমক রায়চৌধুরী (উপরে বাঁ দিক থেকে), সৌমিত্র সেনগুপ্ত, তরুণ সৌরদীপ, (নীচে বাঁদিক থেকে) পার্থ ঘোষ, নারায়ণ বন্দোপাধ্যায় ও অমিতাভ রায়চৌধুরী।

‘‘তার জন্য আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করা উচিত। তবে অন্য ভাবেও যে ভাবা যায়, সেই সম্ভাবনাটা উস্‌কে দেওয়ার কৃতিত্ব তো সুবীরদের ষোলো আনাই দিতে হবে’’, বলছেন অমিতাভ।

সুপারনোভার তথ্যে বিভ্রান্তি থাকতে পারে: তরুণ সৌরদীপ

যদিও সুবীর ও তাঁর সহযোগীদের এই নজরকাড়া গবেষণাকে বিনা প্রশ্নে ‘নম্বর দিতে’ রাজি নন ভারতের এক জন বিশিষ্ট মহাকাশবিজ্ঞানী। পুণের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার পুণে)’-এর পদার্থবিজ্ঞানের চেয়ার প্রফেসর তরুণ সৌরদীপের বক্তব্য, ‘‘এটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। তবে প্রায় সাড়ে ৭০০ সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সুবীর ও তাঁর সহযোগীরা। তা ছাড়াও পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া যে ধরনের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেছেন ওঁরা, তাতে ‘আননোন সিসটেমেটিক এফেক্ট’ থাকতে পারে। এটা যদি সিএমবি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে করা হত, তা হলে অন্য কথা বলতাম।’’

আরও একটি গবেষণায় একই পর্যবেক্ষণ জরুরি: পার্থ ঘোষ

তবে তরুণের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হতে রাজি নন ‘সত্যেন্দ্রনাথ বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস (এসএনবিএনসিবিএস)’-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নোবেলজয়ীরাও তো সুপারনোভাই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই তাঁদের বিশ্লেষণ ছিল, সব দিকে সমান ভাবে আরও আরও বেশি ত্বরণ হচ্ছে মহাবিশ্বের। সেটা যদি মান্যতা পায়, তা হলে সুপারনোভার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই সুবীরদের বিশ্লেষণকে বাতিল করে দেওয়াটা কি সমীচীন হবে? বরং আমি বলব, আরও পর্যবেক্ষণ এই গবেষকদের দাবিকে সমর্থন করে কি না, সেটা দেখতে হবে।’’

পার্থর মতে, ‘‘যাঁরা সুপারনোভার চেয়ে সিএমবি পর্যবেক্ষণে গুরুত্ব দিতে চান, তাঁদেরই দায়িত্ব সিএমবি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সুবীর ও তাঁর সহযোগীদের বিশ্লেষণকে ভুল প্রমাণ করা। সেটা যত দিন না হচ্ছে, তত দিন সুবীরের বিশ্লেষণকে মেনে নিতে অসুবিধাটা কোথায়?’’

গবেষকদের পক্ষে আপাতত কিছু সুখবর, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা ‘ইসা) মহাকাশে থাকা টেলিস্কোপ ‘এক্সএমএম নিউটন’-এর পর্যবেক্ষণ তাঁদের সুরেই কথা বলেছে। জানিয়েছে, মহাবিশ্ব কোনও বিশেষ একটি দিকেই উত্তরোত্তর আরও বেশি গতিতে (বা, ত্বরণ) ফুলে-ফেঁপে উঠছে। যদিও আর একদল গবেষকের দাবি, এই পর্যবেক্ষণে কিছু গলদ রয়েছে।

ডার্ক এনার্জি তত্ত্বের অসঙ্গতি নিয়ে আর প্রশ্ন তুলতে হবে না? সৌমিত্র সেনগুপ্ত

ঘটনা হল, ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব নিয়ে বহু মডেল, বহু তত্ত্ব রয়েছে। ঘটনা হল, সবক’টিরই কোনও না কোনও অসঙ্গতি রয়েছে। আর তা নিয়ে অমীমাংসিত প্রশ্নও থেকে গিয়েছে।

“ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব নিয়ে যে তত্ত্বটি আপাতত সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য, সেই কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট (মহাকর্ষীয় ধ্রূবক, যার ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন আইনস্টাইন)-এর মধ্যেও অসঙ্গতি রয়েছে যথেষ্টই’’, বলছেন কলকাতার ‘ই্ন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (আইএসিএস)’-এর সিনিয়র প্রফেসর সৌমিত্র সেনগুপ্ত। ।

কোথায় সেই অসঙ্গতি? সৌমিত্রের ব্যাখ্যা, “ওই মডেলকে মেনে নিতে গেলে এটাও মেনে নিতে হয় যে, অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি সংখ্যার (দশমিকের পর ৫২টি শূন্যের পরে কোনও সংখ্যা) অত্যন্ত সামান্য হেরফের ঘটলেই যেন তছনছ হয়ে যাবে এই মহাবিশ্ব। যেন ফুৎকারেই উড়ে যাবে! এটা শুনতে অবাস্তব লাগে বলেই কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের মাধ্যমে ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। যার সদুত্তর মেলেনি এখনও পর্যন্ত।’’

তাই একবারেই অন্য ভাবে ভাবার সাহস দেখানোর জন্য সুবীর ও তাঁর সহযোগীদের কাজকে তারি‌ফ করে সৌমিত্র বলেছেন, “সুবীরদের দাবি পরে আরও শক্ত জমিতে প্রমাণিত হলে হয়তো ডার্ক এনার্জি নিয়ে অমীমাংসিত প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের আর ভাবনাচিন্তা করারই কোনও প্রয়োজন হবে না।’’

এই গবেষণা ‘গ্রেট অ্যাট্রাক্টারে’র কথা মনে পড়াচ্ছে: সোমক রায়চৌধুরী

পুণের ‘ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)’-এর অধিকর্তা দেশের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোমক রায়চৌধুরীর কাছে এই গবেষণার যে দিকটি যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে, তা হল, আকাশের যতটা এলাকাজুড়ে পর্যবেক্ষণের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করা হয়েছে, এর আগে ততটা এলাকার উপর পর্যবেক্ষণে এমন কিছু বোঝা যায়নি। যে এলাকাটির পরিমাপ ১০ গিগা আলোকবর্ষ (১০০ কোটি আলোকবর্ষ) বা তারও বেশি হতে পারে।

সোমকের কথায়, ‘‘আকাশের এত বিশাল একটা এলাকায় গ্যালাক্সিগুলির এই একদেশদর্শিতা দেখেছেন গবেষকরা। এটা চমকপ্রদ। এর ফলে, এ বার প্রশ্ন উঠতে পারে কেন বিশেষ একটি অভিমুখেই গ্যালাক্সিগুলি, গ্যালাক্সির ঝাঁকগুলি উত্তরোত্তর আরও আরও বেশি গতিতে সরে যাচ্ছে? আর সেটা কী ভাবেই বা ব্রহ্মাণ্ডের এই এতটা বয়স পর্যন্ত হয়ে চলেছে?’’

তাঁর গবেষক জীবনের গোড়ার দিকে, আট আর নয়ের দশকের মাঝামাঝি মহাবিশ্বের বিশেষ একটি দিকের প্রতি ‘পক্ষপাতে’র ইঙ্গিত পেয়েছিলেন সোমক। তৈরি হয়েছিল হাইপোথিসিস। তা হলে হয়তো অসম্ভব ভারী কোনও পদার্থের ভান্ডার রয়েছে কোথাও, যার অনিবার্য টানে সেই বিশেষ অভিমুখেই মহাবিশ্বের উত্তরোত্তর ত্বরণটা হচ্ছে বেশি।

সোমক জানাচ্ছেন। যে টানছে বলে ভাবা হয়েছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘গ্রেট অ্যাট্রাক্টার’। কিন্তু খোঁজতল্লাশির পরেও তেমন কিছুর প্রমাণ মেলেনি। শুধু তাই নয়, তাঁরা যে একদেশদর্শিতা দেখেছিলেন, তা আকাশের অনেক কম এলাকায়। ৫০ কোটি আলোকবর্ষের মতো। তবে তখন এটাও বোঝা গিয়েছিল, আকাশের আরও বড় এলাকাতেও এই ঘটনা দেখা যেতে পারে। তবে ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানী মহলের বিশ্বাস এতটাই যে, কোনও ‘গ্রেট অ্যাট্রাক্টার’-এর খোঁজতল্লাশ আর আকাশের আরও বড় এলাকায় পরে করা হয়ে ওঠেনি।

সুপারনোভা আর মহাবিশ্বের স্থায়িত্ব

১৯৯৮ সালে দুটি গবেষণা দল (Riess, Perlmutter and Schmidt) মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কে বুঝতে গবেষণায় নেমে পড়েছিলেন। মহাবিশ্ব কি আজীবন একই হারে সম্প্রসারিত হবে? যেহেতু মহাবিশ্ব পদার্থ দিয়ে পূর্ণ, এদের গ্রাভিটির কারনে মহাবিশ্ব এক সময় ধীর গতিতে সম্প্রসারিত হতে হতে থেমে যেয়ে সংকুচিত ও হতে পারে। গবেষণা দল দ্বয় Type 1a সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন। নক্ষত্র জীবনের শেষ দিকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে আলো ছড়িয়ে দেয়। একে বলা সুপরনোভা। সুপারনোভা খুবই উজ্জ্বল হয়।
এই পর্যবেক্ষণের মূল ধারনা ছিল অনেকটা এই রকম- সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করে দূরবর্তী গ্যালাক্সীর গতি বোঝা যায়। কোন সুপারনোভা ৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত মানে এটি থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে ৫ মিলিয়ন বছর সময় লাগবে। সুতরাং আমরা যখন টেলিস্কোপে দেখব তখন তা ৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে কী অবস্থায় ছিল তাই দেখতে পাব। ৫ বিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরের কোন গ্যালাক্সীর বেগ পরিমাপ করা গেল মানে ৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে গ্যালাক্সীর গতিবেগ পাওয়া গেল। এইভাবে আরো দূরের সুপারনোভার লালবিচ্যুতি হিসাব করে গ্যালাক্সীর আরো অতীতের গতি বোঝা যাবে। গ্যালাক্সীর গতিবেগ থেকে মহাবিশ্বের সম্রসারণের গতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

দুই গবেষণাদল যখন তাদের রির্পোট প্রকাশ করল তখন আশ্চার্য হয়ে দেখা গেল মহাবিশ্বের আসলে পূর্বের থেকে দ্রুততার সাথে সম্প্রসারিত হচ্ছে। আরো হিসাব নিকাশ করে বোঝা গেল মহাবিশ্ব প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর পূর্ব থেকেই ত্বরান্বিত গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারন সব সময় একই হারে হয়নি। এখনো পর্যন্ত যা বোঝা যায় তাতে মনে হয় মহাবিশ্বের সম্প্রসারন প্রথম অবস্থা থেকে এক সময় কমতে শুরু করে এবং ৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে (অর্থাৎ মহাবিশ্বের বয়স যখন ৯ বিলিয়ন বছর) থেকে সম্প্রসারনের গতি ত্বরান্বিত হতে শুরু করে এবং এখন দ্রুততার সাথে সম্প্রসারিত হচ্ছে (উপরের ছবির হলুদ রেখা)। একটা এনালজি দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। মনে করেন আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন। দূরে ট্রাফিকের লাল বাতি দেখে ব্রেক কষে গাড়ির গতি কমাতে শুরু করলেন কিন্তু সিগনালে পৌছাবার পূর্বেই সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। তখন আপনি গতি বাড়াতে শুরু করলেন এবং পূর্বের থেকে দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করলেন। ঠিক তেমনি মহাবিশ্বের সম্প্রসারন প্রথম অবস্থা থেকে কমতে কমতে এক সময় আবার বাড়তে থাকে এবং পূর্বের থেকেও দ্রুত গতিতে চলতে সম্প্রসারিত হতে থাকে (Accelerated Expansion) ।

ত্বরান্বিত সম্প্রসারণ ও ডার্ক এনার্জি :

কিন্তু মহাবিশ্ব কেন আরো দ্রুত গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে? বিজ্ঞানীরা বললেন কোন এক গ্রাভিটেশনালি রিপালসিভ শক্তির কারনে এমনটি ঘটছে। বিজ্ঞানীরা ডার্ক এনার্জিকে এ ধরনের বল বলে ধারনা করলেন। ডার্ক এনার্জি হল একটি এন্টি গ্রাভিটি [যা গ্রাভিটির মত মহাবিশ্বের সব কিছুকে আকর্ষণ করে না, বরং বিকর্ষণ করে] বল যা মহাবিশ্বের ত্বরান্বিত সম্প্রসারনের (Accelerated Expansion) জন্য দায়ী। আসলে কোন এক ধরনের এন্টি গ্রাভিটি বলের চিন্তা প্রথম করেছিলেন আইনস্টাইন। যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট এবং একে গ্রীক অক্ষর Λ – ল্যামডা দ্বারা সমীকরনে প্রকাশ করেছিলেন। আইনস্টাইনের সম্মানার্থে ডার্ক এনার্জিকে Λ-ল্যামডা দিয়ে চিহিৃত করা হয়। যদিও আইনস্টাইন কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের ধারনাকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসাবে বলেছিলেন। কিন্তু তার এই ভুল শুদ্ধ হয়ে আত্মপ্রকাশ করল এক সময়।

ডার্ক এনার্জি ও মহাবিশ্বের পরিণতি :

ডার্ক এনার্জি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। এর ধরন বুঝতে বিজ্ঞানীদের সময় লাগবে। তবে ধারনা করা যায় এই এন্টি গ্রাভিটি বল দুইভাবে আচরন করতে পারে। মহাবিশ্ব কীভাবে শেষ হবে তা বুঝতে হলে ডার্ক এনার্জির ধরন বোঝা জরুরী ।

ক. ডার্ক এনার্জি যদি কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের মত কাজ করে

আমরা নিশ্চই আইনস্টাইনের থেকে বেশী বুদ্ধিমান নই। আইনস্টাইন মহাবিশ্বকে স্থির রাখতে কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের ধারনা প্রবর্তন করেন। কিন্তু তার এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়, যা আমরা আগে পড়েছি। কিন্তু ধারণাটি রয়ে গেছে । ডার্ক এনর্জির মত কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট ও এন্টি গ্রাভিটি বল। কিন্তু এ দুটি কী এক? আইনস্টাইনের মতে মহাবিশ্ব সম্প্রসারনের সাথে সাথে কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের ঘনত্বের পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হলে কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের মান ও বাড়ে, ফলে ঘনত্ব একই থাকে। ডার্ক এনার্জি যদি এই রকম হয় অর্থাৎ মহাবিশ্ব সম্প্রসারনের সাথে সাথে ডার্ক এনার্জির গড় ঘনত্ব একই থাকে তবে নিম্নের লেখা থেকে মহাবিশ্বের পরিণতি ব্যাখ্যা করা যায়-

মহাবিশ্বের শুরুতে পদার্থের গড় ঘনত্ব(ρ_m) ডার্ক এনার্জির গড় ঘনত্ব (ρ_Λ) থেকে অনেক বেশী ছিল। প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর ধরে সম্প্রসারনের ফলে পদার্থের গড় ঘনত্ব হ্রাস পায় কিন্তু ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব একই থাকে। এক সময় ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব পদার্থের থেকে বেশী হয়ে যায় (৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে) তখন থেকে মহাবিশ্ব আরো দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হয়।

এভাবে চলতে থাকলে এখন থেকে ৩০ বিলিয়ন বছর পর মহাবিশ্ব এতই সম্প্রসারিত হবে যে কেবলমাত্র হাজার খানেক গ্যালাক্সী দৃষ্টি সীমার মধ্যে থাকবে। অন্যান্য গ্যালাক্সী গুলো লালবিচ্যুত হয়ে দৃশ্যমান বর্ণালী থেকে দূরে সরে যাবে ফলে আমরা আর দেখতে পাব না।

খ. ডার্ক এনার্জি যদি কসমোলজিক্যাল কনস্টান্টের মত আচরণ না করে

কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন ডার্ক এনার্জি কসমোলজিক্যাল কনস্টান্টের মত আচরণ নাও করতে পারে । অর্থাৎ মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের সাথে সাথে ডার্ক এনার্জির গড় ঘনত্বও কমে যাবে। তারা মনে করেন ডার্ক এনার্জি এক ধরনের পদার্থের কারনে হয় যা গ্রাভিটেশনালি নেগেটিভ প্রেসার তৈরি করে। কিছুদিন আগে এক গবেষণায় একটি দল (University of Portsmouth and the National Astronomical Observatories of China (NAOC)) যারা দেখেন যে ডার্ক এনার্জি সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল বা গতিশীল (dynamic) যাকে আগে শূন্য শক্তি হিসাবে ধারনা করা হত যার কোন পরিবর্তনশীল বা গতিশীলতার বৈশিষ্ট্য নেই। তারা এ পদার্থের নাম দিয়েছেন কুইন্টিসেন্স (quintessence) [এরিস্টটলের স্বর্গীয় পদার্থের নাম অনুসারে]। এ ক্ষেত্রে ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব কীভাবে পরিবর্তন হবে তার উপর নির্ভর করে ব্রহ্মাণ্ড সম্প্রসারনশীলও থাকতে পারে বা সংকুচিত হতে পারে।

Scientists have observed the dynamic nature of dark matter, possibly changing the cosmological constant proposed by Einstein.

ডার্ক এনার্জি এখন পদার্থ বিজ্ঞানে সবচেয়ে বড় রহস্য। ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। মিল হল নামে। এদের সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না বলে ডার্ক নাম দেওয়া হয়েছে। ডার্ক ম্যাটার গ্রাভিটির মত আকর্ষিক এবং ডার্ক এনার্জি এন্টি গ্রাভিটি শক্তি এরা বিকর্ষিক। তবে এর কেউই আলোর সাথে ক্রিয়া করে না বলে এদের সম্পর্কে গবেষণা করা মুশকিল। বর্তমান মহাবিশ্বের শক্তি ভরের ৬৮% ডার্ক এনার্জি ২৭% ডার্ক ম্যাটারও ৫% অন্যান্য ম্যাটার। তাই এটা গবেষনার সবচেয়ে বড় জায়গা। আমরা ভবিষ্যতে আরো জানতে পারব এ সম্পর্কে। তখন হয়তো দেখবো দেড় হাজার বছর আগের আল কোর’আনে আল্লাহ তা’আলা যে কথা বলেছেন,

“সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব যেমনভাবে (লিখিত) কাগজ-দলীল গুটিয়ে রাখা হয়। যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে আবার সৃষ্টি করব। ওয়া‘দা আমি করেছি এবং তা আমি পূরন করবই।” (আল আম্বিয়া ২১: ১০৪)

আর বেদে যা বলা আছে-

বৰ্তমান যুগকে কলি যুগ বলে গণ্য করা হয়। প্ৰায় ৪,৩২,০০০ বছর (লুডো রোচারের মতে) পর ভগবান বিষ্ণুর অন্তিম অবতার কল্কিয়ে ব্ৰহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব কাল সমাপ্ত করবেন, শিবই সব কিছু ধ্বংস করবেন। ব্ৰহ্মাণ্ড পুনরায় সৃষ্ট হবে।

তা সত্যি হবে, আমরা পেয়ে যাব এর বৈজ্ঞানিক প্রমান।

প্রমাণ হবে মহাবিশ্ব এখন যেমন সম্প্রসারনশীল তেমনি একদিন সংকুচিত হবে, ধ্বংসও হবে। একমাত্র এর স্রষ্টাই থাকবেন অবিনশ্বর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *