স্টিলথ প্রযুক্তি কি? এটি কীভাবে কাজ করে?

যুদ্ধের সময় বা অন্য দেশের আকাশে চরবৃত্তি করবার সময় যুদ্ধবিমান গুলিকে শত্রুপক্ষের দৃষ্টির আড়াল করার জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তারই পোশাকী নাম স্টীল্থ প্রযুক্তি (Stealth Technology)।

এই প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে তা বলার আগে এই প্রযুক্তির বিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলে নিই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (WWI) আগে থেকেই যুদ্ধবিমান গুলিকে কিভাবে শত্রুপক্ষের চোখের আড়ালে ব্যবহার করা যায়, তার গবেষণা চলছিল। অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি প্রথম তাদের যুদ্ধবিমান গুলিতে সেলুলোজ অ্যাসিটেট (Cellulose Acetate – ফোটোগ্রাফির সেলুলয়েড ফিল্ম এই যৌগ দিয়ে তৈরি হয়) নামে একটি স্বচ্ছ যৌগের আস্তরণ লাগায়। এতে বিমানগুলিকে ৯৬০ ফুট উচ্চতার উপরে আর খালি চোখে দেখা যেত না।

যাইহোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (WWII) রাডার (RADAR) আবিষ্কার হওয়ার পর এই পদ্ধতিটি মাঠে মারা যায়। যেহেতু রাডার রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে কাজ করে, দৃশ্যমান আলো থেকে সেলুলোজ অ্যাসিটেট বিমানগুলিকে অদৃশ্য করতে পারলেও রাডার থেকে অদৃশ্য করতে পারতোনা। ফলে সহজেই বিমানগুলিকে শনাক্ত করে অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া যেত।

তবে এবারও জার্মানি তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। তারা এমন এক রঙ(Paint) আবিষ্কার করে, যা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি শোষণ করে নিতে পারত। এর ফলে বিমানগুলিতে এই রঙ করে দিলে সেগুলি রাডারে ধরা পড়ত না। তবে লৌহ সমৃদ্ধ (Iron Oxide based) হওয়ায় এই রঙ বিমানের ওজন বাড়িয়ে দিত। এরপর ষাটের দশকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ রাডার স্টীল্থি (RADAR Stealthy) সঠিক বাংলা তর্জমা না করতে পারার জন্য দুঃখিত) অনেক উচ্চতা থেকে টহল দিতে সক্ষম বিমান (High Altitude Reconnaissance Aircraft) “Lockheed SR71 Blackbird” তৈরি করে। এই বিমানটির গঠন এমন ছিল যাতে রাডার সিগন্যাল শোষণ করে নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দিকে প্রতিফলিত করে দেওয়া যেত। বিমানটিতে “Iron Ball” নামে একধরণের রঙের কোটিং দেওয়া হয়েছিল, যা প্রতিফলিত রাডার সিগন্যালকে বৈদ্যুতিন ভাবে পরিবর্তন (Electronically Manipulate) করতে পারতো।

এবার বলি স্টীল্থ প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে। অনেক রকম পদ্ধতি এবং পদার্থ (Material) ব্যবহার করা হয় এই প্রযুক্তিতে। মোটামুটিভাবে চার রকমের স্টীল্থ প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়। এগুলি হল

  1. ভিজ্যুয়াল স্টীল্থ (Visual Stealth)
  2. ইনফ্রারেড স্টীল্থ (Infrared Stealth)
  3. অ্যাকোস্টিক স্টীল্থ (Acoustic Stealth) এবং
  4. রাডার স্টীল্থ (RADAR Stealth)

ভিজ্যুয়াল স্টীল্থ :

ভিজ্যুয়াল স্টীল্থ : মূলতঃ খালি চোখে যাতে একটি বিমানকে দেখা না যায় সেজন্য বিমানগুলিকে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন রঙ করা হয়। যেমন, যে যুদ্ধবিমানগুলি দিনের আলোতে ব্যবহার করা হয়, সেগুলিকে হাল্কা ধূসর আকাশী নীল (Air Superiority Blue Gray) রঙের করা হয়, যাতে আকাশের রঙের সাথে বিমানটির পার্থক্য বোঝা না যায়।

ছবি : বোইং এফ/এ ১৮ হর্নেট

আবার যে বিমানগুলি অনেক উচ্চতা দিয়ে ওড়ে, আকাশের কালো রঙের সাথে মিলিয়ে সেগুলিকে কালো রঙের করা হয়। রাত্রিবেলাতেও এই বিমানগুলিকে খালি চোখে দেখা যায়না।

ছবি : লকহীড এফ ১১৭ নাইটহক

বর্তমানে “Chameleon” বা “Smart Skin” নামে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যাতে পরিবেশ অনুযায়ী বিমানের রঙের পরিবর্তন করা যায়। এছাড়াও গ্লিন্ট (বিমানের ককপিট এবং চকচকে অংশ থেকে প্রতিফলিত তীব্র আলোর ঝলকানি) প্রতিরোধের জন্য বিমানটিকে ম্যাট ফিনিশ করা হয়।

ইনফ্রারেড স্টীল্থ :

ইনফ্রারেড স্টীল্থ : পরম শূণ্য (Absolute Zero) তাপমাত্রার উপরে যেকোন বস্তু থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি (কি এবং কেন তা এই স্বল্প পরিসরে বলার সুযোগ কম) নিঃসরণ হয় এবং বিমানগুলো ও তার ব্যতিক্রম নয়। ইনফ্রারেড সেন্সর ব্যবহার করে খুব সহজেই তাই চিহ্নিত করা যায়। এই কারণে ইনফ্রারেড স্টীল্থের জন্য চেষ্টা করা হয় বিমানগুলিকে যতটা সম্ভব ঠান্ডা রাখার। সাধারণতঃ যে যে পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করা হয়, সেগুলো হল,

  • ইঞ্জিন গুলি বিমানের মূল অংশের মধ্যে বা ডানার নিচে রাখা হয়।
ছবি : একটি ফাইটার বিমানে ইঞ্জিনের অবস্থান
  • বিমানের যে অংশগুলি সহজে উত্তপ্ত হয়ে যায়, সেগুলিতে তাপনিরোধক পদার্থের আস্তরণ দেওয়া হয়।
  • উত্তপ্ত এক্সহস্ট গ্যাস নিঃসরণের আগে ঠান্ডা বাতাস মিশ্রিত করা হয়।
  • এক্সহস্ট গ্যাস অনেকগুলি হীট সিঙ্ক ফিনের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয় যাতে তা দ্রুত ঠান্ডা হয়।
  • এক্সহস্ট গ্যাস বিমানের উপর দিয়ে নিঃসরণ করা হয় যাতে নিচ থেকে (Ground Station) কেউ চিহ্নিত না করতে পারে।

এছাড়াও ইনফ্রারেড জ্যামিং (Infrared Jamming) নামে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যাতে একটি ইনফ্রারেড রেডিয়েটর দিয়ে ইনফ্রারেড রশ্মি খুব দ্রুত ছাড়া ও বন্ধ (Flicker) করা হয়।এর ফলে ট্র্যাকিং ডিভাইস গুলি সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না।

অ্যাকোস্টিক স্টীল্থ :

অ্যাকোস্টিক স্টীল্থ : যেকোনো বিমানের ইঞ্জিন প্রচন্ড শব্দ সৃষ্টি করে। এই শব্দের উৎস খুঁজে বিমানের গতিবিধি খুব সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। শব্দ কম করার জন্য ইঞ্জিনগুলিকে শব্দ শোষণকারী আবরণ (Silencer Suppressor Muffler) দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এছাড়াও বিমানগুলিকে যতটা সম্ভব হাল্কা বানানো হয় এবং প্রপেলার গুলি কাঠের তৈরি করা হয় কারণ কাঠের তৈরি প্রপেলার খুব কম আওয়াজ করে।

রাডার স্টীল্থ :

রাডার স্টীল্থ : স্টীল্থ প্রযুক্তিগুলির মধ্যে রাডার স্টীল্থ হল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। মূলতঃ দু’রকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় রাডার থেকে বাঁচার জন্য – ১. শোষণ (Absorption) এবং ২. বিচ্যুতি (Deflection)।

  • শোষণ (Absorption) : ধাতব পদার্থ রেডিও ওয়েভ প্রতিফলিত করতে পারে। রাডার সিগন্যাল শোষণকারী পদার্থের আস্তরণ দেওয়া হলে বিমানের ওজন বৃদ্ধি পায় যা নিস্প্রয়োজন। এজন্য বিমানগুলিকে রাডার শোষণকারী পদার্থ দিয়ে বানানো হয় যাতে বিমানগুলোর ওজন কম হয়। উদাহরণ স্বরূপ, এফ ১১৭ এয়ারক্রাফ্টটির প্রায় পুরোটাই ফাইব্যালয় (Fibaloy – গ্লাস ফাইবার এবং কার্বন ফাইবার এর মিশ্রণ) নামে একটি রাডার শোষণকারী পদার্থ দিয়ে বানানো। এছাড়াও বিমানের বিভিন্ন অংশ কিছু বিশেষ জ্যামিতিক আকারে বানানো হয় যাতে বেশি ক্ষেত্র জুড়ে সিগন্যাল শোষণ করতে পারে। ইঞ্জিনের ইনটেক রাডার সিগন্যালের জন্য ইকো চেম্বার (Echo Chamber) হিসেবে আচরণ করে, যার ফলে রাডার সিগন্যাল আরো শক্তিশালী ভাবে প্রতিফলিত হয়। এরজন্য ইনটেক ভেন (Intake Vane) গুলির সামনে ধাতব পর্দা টাঙানো হয়, যা শোষক হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে প্লাজমাও (উচ্চ তাপমাত্রা বিশিষ্ট গ্যাস) ব্যবহার করা হয় রাডার সিগন্যাল শোষণ করার জন্য। এই পদ্ধতিতে বিমানের সামনে থেকে প্লাজমা নিঃসরণ করা হয় যা পিছনের দিকে প্রবাহিত হয়ে বিমানটিকে একটি চাদরের মতো মুড়ে রাখে। তবে এই পদ্ধতিতে বিমানটির জন্য ইনফ্রারেড স্টীল্থ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
  • বিচ্যুতি (Deflection) : সাধারণতঃ গ্রাউন্ড রাডার সিস্টেম গুলি একটি জায়গায় বসানো থাকে। এখন কোনভাবে যদি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে আসা রাডার সিগন্যাল যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে প্রতিফলিত না করে অন্য দিকে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে গ্রাউন্ড স্টেশনের পক্ষে বিমানটিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। এটিই হল বিচ্যুতি। বিমানের গঠনে কোন সমান তল (Flat Surface) না থাকা হল বিচ্যুতির প্রধান শর্ত যদিও প্রায় সব যুদ্ধ বিমানের গঠন সমান তলাবিশিষ্ট করা হয় উচ্চ গতির জন্য। উদাহরণ স্বরূপ, বি২ বোমারু বিমান ব্যুমেরাং আকৃতির হয়।
ছবি : বি ২ বোম্বার

পরিশেষে এটাই বলব, সমস্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি একটি বিমান সঠিক ভাবে এবং সঠিক সময়ে চালানোও (Stealth Fighting) সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটি কালো রঙের বিমান যদি দিনের আলোয় চালানো হয়, তবে বিমানটি খালি চোখেই দেখা যাবে এবং প্রযুক্তির সমস্ত ব্যবহারই তখন হবে ব্যর্থ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *